যাকাত ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বুনিয়াদ

0

ইউছুফ আরমান: 

যাকাত ইসলামী অর্থ ব্যবস্থায় মূল ভিত্তি। অভাব ও দারিদ্র দূর করে সমাজে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়নে যাকাতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। রাসূল (স) দৃপ্তকন্ঠে ঘোষণা করেছেন-যাকাত ইসলামের সেতু বন্ধন। যাকাত শুধু উম্মতে মোহাম্মদীর উপর ফরজ করা হয় নাই। বরং পূর্ববর্তী নবীগণের উম্মদের উপর ও ফরজ করা হয়েছিল। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেন- “আমি তাহাদিগ কে ইমাম বানাইয়া দিয়াছি, তাহারা আমারই হুকুম অনুযায়ী মানুষ কে পরিচালিত করে। আমি অহীয় মারফতে তাহাদিগ কে ভাল কাজ করার, নামাজ আদায় করার এবং যাকাত দেওয়ার হুকুম দিয়াছি। তাহারা নিষ্ঠার সাথে আমার ইবাদত-বন্দেগী করতো আমার হুকুম ঠিকমত পালন করতো”। নিম্মে যাকাতের পরিচয় ও ব্যয় ক্ষেত্র সমূহ বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

যাকাত অর্থঃ- যাকাত দ্বারা মালের বৃদ্ধি পাওয়া, মালের পবিত্রতা লাভ করা, অর্থ সম্পদের প্রাচুর্য, ধন-সম্পদে আল্লাহর প্রশংসা করা।
আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে শরীয়ত কর্তুক নির্ধারিত মালের একাংশ হাশেমী ও তাদের দাসদাসী ব্যতিত অন্য মুসলিম দরিদ্র কে বিনা স্বার্থে প্রদান করার নাম হচ্ছে যাকাত।

স্কীয় মালিকানাধীন সম্পত্তি হতে প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট অংশ শরীয়তের নিদের্শানুপাতে বের করে দেয়া কে যাকাত বলা হয়।
কারো নিকট নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে এবং এর ওপর এক বছর অতিক্রান্ত হলে তার চল্লিশ ভাগের এক ভাগ আল্লাহর রাস্তায় দান করা কে যাকাত বলা হয়।

আল্লাহ তায়ালা কুরআন পাকের বলেন- “যাহারা স্বর্ণ-রৌপ্য জমা করিয়া রাখে এবং উহা আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় খরচ করে না, আপনি হে মুহাম্মদ! তাহাদিগ কে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তির সংবাদ জানাইয়া দিন। সেই দিবসে অর্থাৎ ভীষণ কেয়ামতের দিন উক্ত স্বর্ণ-রৌপ্য দোযখের আগুনে গরম করা হইবে, পরে তাহা দ্বারা তাহাদের চেহারা, পাঁজর, পৃষ্ঠ ইত্যাদি স্থানে দাগ দেওয়া হইবে, আর ফেরেশতাগণ বলিতে থাকিবে, ইহা ঔ বস্তু যাহা তোমারা নিজের জন্য সঞ্চয় করিয়াছিল, এখন উহার আস্বাদ গ্রহণ কর”। রাসুলে পাক (স) অন্য এক হাদিসে ইরশাদ করেছেনঃ- আল্লাহ তায়ালা যাহাকে ধন-দৌলত প্রদান করিয়েছেন কিন্তু সে ব্যক্তি উহার উপর যাকাত আদায় করল না, তাহার সেই ধন-দৌলত কেয়ামতের দিন এই রূপ সর্পে পরিণত হইবে, যাহার মস্তকে কেশ নাই এবং চক্ষু দু’ টি কালো তিলক থাকিব, ঐ সর্পে তাহার গলা জড়াইয়া ধরিবে এবং দংশন করিয়া বলিতে থাকিবে, আমি তোমার অর্থ ও ধন ভান্ডার।

আল্লাহ পাক কুরআনে বলেনঃ- তাহাদের ধন সম্পদ হইতে যাকাত উসূল করিয়া তাহাদিগ কে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করিয়া দাও।
যাদের উপর যাকাত ফরজঃ- ঢালাওভাবে সবার উপর যাকাত ফরজ নয়। যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য কতক গুলো শর্ত বিদ্যামান। নিম্মে সে গুলো উপস্থাপন করা হলো।

স্বর্ণ এক বছর থাকলেঃ- কারো মালিকানায় ২০ মিসকাল বা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ পূর্ণ এক বছর থাকলে তাকে চল্লিশ ভাগের একভাগ হিসেবে অর্ধ মিসকাল স্বর্ণ যাকাত দিতে হবে।

মুসলিম হওয়াঃ- যাকাত দাতা কে অবশ্যই মুসলমান হতে হবে। অমুসলিমদের উপর যাকাত ফরজ হয় না।
জ্ঞানবান হওয়াঃ- যাকাতদাতা কে জ্ঞানবান হতে হবে, বিকৃত মস্তিস্ক ব্যক্তির উপর যাকাত ফরজ নয়।
স্বাধীন হওয়াঃ- পরাধীন তথা দাসদাসীর ওপর যাকাত ফরজ নয়।
প্রাপ্ত বয়স্কঃ- যাকাত দাতাকে ঋণ মুক্ত হতে হবে। ঋণ গ্রস্থ ব্যক্তির উপর যাকাত ফরজ নয়।
নেসাবের মালিক হওয়াঃ- যাকাত দাতা কে পূর্ণ নেসাব পরিমাণ মালে মালিক হতে হবে। কেন না যার কাছে নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে না তার উপর যাকাত ফরজ হয় না।
এক বছর মালিকানায় থাকাঃ- নেসাব পরিমাণ সম্পদ যাকাত দাতার মালিকানায় পূর্ণ এক বছর থাকতে হবে। অন্য কথা যাকাত ফরজ হবে না।
উপরিক্ত শর্তাবলী কারো মধ্যে থাকলেই কেবল তার উপর যাকাত ফরজ হবে। বর্ণিত শর্তাবলীর কোন একটি অনুপস্থিত থাকলে যাকাত ফরজ হবে না। যাকাতের ব্যয় ক্ষেত্র সমূহ- যাকাত আদায়ের খাত মোট আট টি। যথা-
ফকিরঃ- যার সামান্য সম্পদ আছে, কিন্তু এর দ্বারা সে তার সারা বছরের খাদ্যের ব্যবস্থা করতে পারে না তাকে ফকির বলা হয়। তবে তাকে যাকাত দেয়া যাবে।
মিসকিনঃ- যার কিছু নাই, একেবারে নিঃস্ব তাকে মিসকিন বলা হয়। এদের যাকাতের মাল দেয়া যাবে।
কর্মচারীঃব যাকাত আদায়ের নিযুক্ত কর্মচারী কে তার কর্মানুসারে পারিশ্রমিক হিসেবে যাকাতের মাল থেকে দেয়া যাবে।
মান আকৃষ্টকরণঃ- ইসলামের প্রতি মন আকৃষ্ট করার জন্য অমুসলিমদের কে যাকাত দেয়া। উল্লেখ্য, অধিকাংশ আলেমের মতে, এ বিধান টি বর্তমানে রহিত হয়ে গেছে।
দাস মুক্তঃ- যে ক্রীতদাস তার মালিকের সাথে এ চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে যে, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিলে সে দাসত্বের শৃংখল থেকে মুক্তি পাবে। এ ধরণের দাস কে মুকতার দাস বলে।
ঋণ মুক্তিঃ- ঋণগ্রস্থ ব্যক্তি কে ঋণ থেকে মুক্ত করার জন্য যাকাত দিয়ে সহযোগিতা করা যাবে।
আল্লাহর রাস্তায়ঃ- যে সব মুজাহিদ অর্থভাবে জেহাদে অংশ গ্রহণ করতে পারে না, তাদের হাতিয়ার, যানবাহন ও যুদ্ধাস্ত্র ক্রয় করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে।
পথিকঃ- যার বাসস্থানে সম্পদ আছে, কিন্তু সাথে কিছু নেই, সাময়িক রিক্তহস্ত, এ ধরণের মসাফির তথা ভ্রমণ কারীদের কে যাকাতেরর অর্থ প্রদান করা যাবে।
যাকাত ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বুনিয়াদ। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান দূর কনে বিশ্বব্যাপি একটি সুসংঘবদ্ধ ইসলামী সমাজ বিনির্মাণে যাকাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

গবেষণাপত্র
কুরআন
হাদিস
ফিকহ

লেখকঃ- ইউছুফ আরমান, কলামিষ্ট, সাহিত্যিক, শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ফাজিল, কামিল, বি.এ অনার্স, এম.এ, এলএল.বি।

Leave A Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.