ঈদে ৮০০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ভাড়া মালিক ও চাঁদাবাজরা লুটে নেবে
ঈদযাত্রায় অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ে নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানী বন্ধের দাবী – যাত্রী কল্যাণ সমিতি

0

ঈদযাত্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ভাড়া পরিবহন মালিক-শ্রমিক ও চাঁদাবাজেরা লুটে নিচ্ছে বলে অভিযোগ করে জরুরী ভিত্তিতে এহেন ভাড়া নৈরাজ্য ও পথে পথে যাত্রী হয়রানি বন্ধের দাবী জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।

আজ ২৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার সকালে “ঈদযাত্রায় অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানী বন্ধের দাবী”তে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী এই দাবী জানান।

তিনি বলেন, এবারের ঈদে গণপরিবহন সংকটকে কাজে লাগিয়ে একশ্রেনির অতিলোভী কিছু অসাধু মালিক ও পরিবহন চাঁদাবাজদের নেতৃত্বে ভাড়া নৈরাজ্যের এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। কিছু অসাধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পৃষ্টপোষকতার কারণে সরকার নানাভাবে চেষ্টা করেও এহেন ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধ করতে পারছে না। এবারের ঈদে ২৫ এপ্রিল থেকে ১০ মে পর্যন্ত সকলপথে প্রায় ৬০ কোটি ট্রিপ যাত্রী হতে পারে। তার সিংহভাগ অর্থাৎ ৪০ কোটি ট্রিপ সড়ক পথে, ২০ কোটি ট্রিপ রেল, নৌ ও আকাশ পথে যাতায়াত হতে পারে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ২৫ এপ্রিলের পর থেকে শহরাঞ্চলে রিক্সা ভাড়া ২০ ভাগ বেড়ে গেছে। আগামীকাল থেকে এই ভাড়া ১০০ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে। একই সাথে অটোরিকশা, ইজিবাইক ভাড়াও দ্বিগুণ তিনগুণ বাড়তি আদায় হচ্ছে। সকল রুটে লেগুনা ভাড়া দিগুণ আদায় করা হচ্ছে। সরকার ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে চালক-সহকারীর বেতন ও দুই ঈদের ঈদ বোনাস যাত্রীসাধারণের কাছে থেকে আদায় করে নিলেও চালক সহকারীর বেতন বোনাস না দেওয়ায় রাজধানীর বাস-মিনিবাসে ঈদের ৩ দিন আগে থেকে ঈদের ৩ দিন পর পর্যন্ত উঠানামা সর্বনি¤œ ভাড়া ৫০ টাকা হারে আদায় করা হয়। এবারো এ হারে ভাড়া আদায়ের লক্ষ্যে চালক-শ্রমিক ও পরিবহন চাঁদাবাজরা মরিয়া হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে রাজধানী ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের মহোৎসব চলছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বিআরটিএ, জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমান আদালত নানাভাবে তৎপরতা চালিয়ে, কাউন্টারে কাউন্টারে জরিমানা আরোপ করেও এই ভাড়া নৈরাজ্য ঠেকানো যাচ্ছে না। উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে যাত্রাপথে বিভিন্ন বাসে যাত্রী প্রতি ১০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। নৌ-পথেও ভাড়া নৈরাজ্য চরমে ঠেকেছে। রেলে টিকিট কালোবাজারী, অনলাইনে টিকিট পেতে বিড়ম্বনা অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় এবার চরমে পৌঁছেছে। আকাশ পথেও এহেন ভাড়া নৈরাজ্যের কারণে যাত্রীসাধারণ এখন দিশেহারা।

লিখিত বক্তব্যে জনাব মোজাম্মেল হক চৌধুরী আরো বলেন, বরাবরের মতো এবারো আকাশ পথে ভাড়া নৈরাজ্য চরমে পৌঁছেছে। ঢাকা-বরিশাল ৬১ এ্যারোনটিক্যাল মাইলের উড়োজাহাজের ভাড়া ১৫০০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত ঢাকা-ব্যাংককের ভাড়ার প্রায় দেড়গুণ বাড়তি আদায় করা হচ্ছে। এই রুটে ইউএস বাংলায় ৪০০০ টাকার ভাড়া এখন ১০৮০০ টাকা। নভোএয়ারের ৪৮০০ টাকার ভাড়া এখন ৮৪০০ টাকা। বাংলাদেশ বিমানে ৩০০০ টাকার ভাড়া ৭৪০০ টাকা। ঢাকা-সৈয়দপুর, ঢাকা-কক্সবাজার রুটে ৪৫০০ টাকার নিয়মিত ভাড়া ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায় ঠেকেছে।

গত বছরের নভেম্বরে সরকার ডিজেলের মূল্য ২৩ ভাগ বাড়ানোর সময়ে বাস ভাড়া ২৭ ভাগ ও লঞ্চ ভাড়া ৩৬ ভাগ বাড়ানো হলেও লঞ্চ মালিকেরা নানা কারচুপির মধ্যে দিয়ে সর্বোচ্চ ৪৬ শতাংশ হারে বর্ধিত ভাড়া আদায় করে আসছিলেন। ঢাকা-বরিশাল নৌ-রুটে আগে ডেকের ভাড়া ছিল ২০০ টাকা। ভাড়া বৃদ্ধির পর তা ৩৫০ টাকা হারে আদায় করা হলেও এবারের ঈদে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা হারে আদায় করা হচ্ছে। এক শয্যার কেবিনের ভাড়া ৯০০ টাকা ছিল, ভাড়া বৃদ্ধির পর তা ১২০০ টাকা করা হলেও এবারের ঈদে ১৫০০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। দুই শয্যার ডাবল কেবিনের ভাড়া আগে ছিল ১৮০০ টাকা ভাড়া বৃদ্ধির পর তা ২৪০০ টাকা করা হলেও এখন আদায় করা হচ্ছে ৩০০০ টাকা। আবার এসব টিকিটের কালোবাজারীরা আরো ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকা বর্ধিত মূল্য নিয়ে যাত্রীদের হাতে তুলে দিচ্ছে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণ মতে, এদিকে সড়ক পথে ঢাকা-চুয়াডাঙ্গা, বগুড়া, রাজশাহী, নওগাঁ, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রামসহ উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিটি রুটে যাত্রী প্রতি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা হারে বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। যা আগামীকাল থেকে দিগুণে পৌঁছে যাবে। ঢাকা-রংপুর রুটে হানিফ এন্টারপ্রাইজের ভাড়া আগে ১০০০ টাকা নেওয়া হলেও এখন ১৮০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। এ রুটে ঈগল পরিবহনের ভাড়া ১২০০ টাকা নেওয়া হলেও এখন ১৮০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। শাহআলী পরিবহন ৮৫০ টাকার ভাড়া ১৪০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। ঢাকা-লালমনিরহাট শুভ বসুন্ধরায় ৮০০ টাকার ভাড়া ১৩০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। ঢাকা-পটুয়াখালী সাকুরা পরিবহনের এসি বাসে ১০০০ টাকার ভাড়া ১৪০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রাম থেকে দেশের উত্তরাঞ্চলের পথে বিভিন্ন বাসে দিগুণ ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। আবার কিছু কিছু রুটে স্বল্প দূরত্বে যেতে চাইলেও টিকিট নেই অযুহাত দিয়ে বেশি দূরত্বের টিকিট নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। যেমন ঢাকা চট্টগ্রামের কেরানীহাট বা লোহাগড়ার যাত্রীদের ১০০ কিলোমিটার বেশী দুরত্বে কক্সবাজারের টিকিট কিনতে হচ্ছে। অনুরূপ কেউ কাপ্তাই যেতে চাইলে তাকে রাঙামাটির টিকিট কিনতে হচ্ছে। কেউ রাজশাহী যেতে চাইলে তাকে নওগাঁর টিকিট কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে।

রেলে সার্বিক অব্যবস্থাপনার টিকিট না পেয়ে ৩৫০ টাকার টিকিট কালোবাজারীর কাছ থেকে ১৫০০ টাকায় কেনার খবর গণমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এহেন নৈরাজ্য পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় এবার সড়ক পথে ৪০ কোটি ট্রিপ যাত্রায় যাত্রী প্রতি গড়ে ১০০ টাকা বাড়তি দিলেও প্রায় ৪০০০ কোটি টাকা এবং নৌ, রেল ও আকাশ পথে ২০ কোটি ট্রিপ যাত্রায় যাত্রী প্রতি গড়ে ২০০ টাকা অতিরিক্ত আদায় হলে প্রায় ৪০০০ কোটি টাকা বাড়তি ভাড়া আদায় হবে। এবারের ঈদে ৮০০০ কোটি টাকার বেশি ভাড়া নৈরাজ্যকারী সিন্ডিকেটের পকেটে যাবে। যার ৪০ শতাংশ চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট লুটে নেবে এবং বাকি ৬০ শতাংশ পরিবহন মালিক-শ্রমিক ও নেতাদের পকেটে যাবে। এহেন নৈরাজ্যের কারণে নি¤œ আয়ের লোকজন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস-ট্রাক ও ট্রেনের ছাদে, কাভার্ড ভ্যান, পণ্যবাহী পরিবহন ও ফিটনেসবিহীন যানবাহনে কম ভাড়ায় যাতায়াত করতে বাধ্য  হবে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়বে। তাই জরুরী ভিত্তিতে এহেন ভাড়া নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবী জানিয়েছে সংগঠনটি। এসময় উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের উপদেষ্ঠা পরিষদের সদস্য শরীফুজ্জামান শরীফ, গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ আবদুল হক, সংগঠনের সহ-সভাপতি তাওহিদুল হক লিটন, প্রচার সম্পাদক মাহমুদুল হাসান রাসেল প্রমুখ।

Leave A Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.