করোনার ভয়কে উপেক্ষা রাতভর চেষ্টায় বাঁধ নির্মাণ,১০ গ্রামের মানুষ রক্ষা পেল

0

শেখ সাইফুল ইসলাম কবির.সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার,বাগেরহাট:বাগেরহাটের শরণখোলায় করোনার ভয়কে উপেক্ষা করে রাতভর চেষ্টা চালিয়ে নির্মাণ করা হয় বাঁধটি শরণখোলা ইউএনওর প্রশংসনীয় উদ্যোগ। ভাঙা বাঁধ দিয়ে বলেশ্বরের প্রবল জোয়ারের পানি একবার ঢুকে পড়লে প্লাবিত হতো গ্রামের পর গ্রাম। ব্যাপক ক্ষতি হাতে পারতো শত শত পুকুর, মাছের ঘের, ঘরবাড়ি, ফসলের। কিন্তু উপজেলা প্রশাসনের তাৎক্ষণিক প্রচেষ্টায় বড় ধরণের ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায় বাঁধসংলগ্ন ১০টি গ্রাম। অন্তত ওই রাতের জন্য স্বস্তি ফিরে পায় উৎকণ্ঠিত বাঁধের পাশের মানুষ। আকস্মিক ভাঙনের খবর পেয়ে রবিবার দুপুরে বাগেরহাট-৪, আসনের সংসদ সদস্য কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য এ্যাডভোকেট আমিরুল আলম মিলণ বেড়িবাঁধ এলাকা পরিদর্শন করেছেন ও তার নির্দেশনা অনুযায়ীতার উপস্থিতেনির্মাণ কাজ শুরু।

ঘটনাটি গত শনিবার (৯ মে) রাতের। ওইদিন রাত ৮ টার দিকে বাগেরহাটের শরণখোলার সাউথখালী ইউনিয়নের দক্ষিণ সাউথখালীর গাবতলা আশার আলো মসজিদের সামনের বাঁধ ধসে প্রায় ১০০ ফুট সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায়। তখন বলেশ্বরে ভাটির টান। জোয়ার এলেই ওই ভাঙা বাঁধ দিয়ে হু হু করে বলেশ্বরের নোনা জল ঢুকে পড়বে। ওই মুহূর্তে ঘটনাস্থল থেকে মুঠোফোনে বাঁধ ভাঙার খবর আসে শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সরদার মোস্তফা শাহিনের কাছে। তিন ছুটে যান সেখানে।

ঘটনাস্থলে গিয়ে কথা বলেন জেলা প্রশাসকের সাথে। তার নির্দেশনা অনুযায়ী এলাকার লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে বাঁধটি দ্রুত মেরামতের পরিকল্পনা করেন। খবর দেন পানিউন্নয়ন বোর্ডের ৩৫/১ পোল্ডারে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মানকাজে নিয়োজিত উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পের (সিইআইপি) মাঠ কর্মকর্তাদের।

প্রথমে তারা আসতে অনিহা প্রকাশ করলেও ইউএনওর চাপে এস্কেভেটর মেশিন নিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে আসতে একপ্রকার বাধ্য হয় তারা। ইউএনও’র তদারকিতে শুরু হয় জোয়ারের পানিরোধে রিংবাঁধের কাজ। এ সময় ইউএনও মনোবল জোগাতে গাবতলায় ছুটে যান রায়েন্দা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান মিলনসহ কয়েকজন গণমাধ্যকর্মী।

এদিকে রমজান মাস। রোযার সাহরীও খেতে হবে। রাত যতো গভীর হচ্ছে, সাহরীর সময়ও ততো ঘণিয়ে আসছে। তখন এগিয়ে আসে স্থানীয়রা। তাৎক্ষণিকভাবে শুরু করে সাহরীর জন্য মুরগি-খিঁচুড়ি রান্না। পাল্লাদিয়ে চলছে বাঁধের কাজ। এসই সাথে ফুঁসছে বলেশ্বরের জোয়ারের পানি। ভাগ্য প্রসন্ন, তাই জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ার আগেই সম্পন্ন হয় রিংবাঁধের কাজ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সংশ্লিষ্টরা। এর পর ভাঙা বাঁধের পাশেই আশার আলো মসজিদে বসে সাহরী সারেন ইউএনও ও তার সঙ্গীরা। একজন ইউএনওকে রাত জেগে মানুষের জান-মাল রক্ষার জন্য নিরলসভাবে কাজের তদারকি করতে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে গ্রামবাসীরা।

ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ খান (৬৫), আবুল কালাম হাওলাদার (৪৫), ছগির হাওলাদার (৩৫) আবেগ ও উচ্ছাস প্রকাশ করে বলেন, ওই রাতে ইউএনও স্যার ছুটে না এলে আমাদের বলেশ্বরের পানিতে ডুবে মরতে হতো। আমরা উপস্থি থেকে দেখেছি তার মানবিকতা। তিনি আমাদের জন্য যে কষ্ট করেছেন তার ঋণ আমরা কোনোদিন শোধ করতে পারবো না।

দক্ষিণ সাউথখালী গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা আ. বারেক হাওলাদার (৮৫) জানান, বলেশ্বরের ভাঙন তাদের নিঃস্ব করেছে। প্রতিবছর কমপক্ষে দুই-তিনবার বাঁধ ভাঙে। এর পর নামমাত্র রিংবাঁধ দিয়েই দায়িত্ব এড়িয়ে যায় সংশ্লিষ্টরা। অথচ কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়ায় বছর বছর তাদের সহায়-সম্পদ নদীতে গিলে খাচ্ছে।

মুক্তিযোদ্ধা বারেক হাওলাদার আরো জানান, বগী, দক্ষিণ সাউথখালী ও গাবতলা গ্রামের শত শত মানুষ ভাঙনে শিকার হয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। তার বাপ-দাদাদের প্রায় সোয়াশো বিঘা জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। ভাঙতে ভাঙতে এখন মাত্র দুই বিঘা জমি আছে তাদের। দ্রুত ভাঙন রোধের উদ্যোগ না নিলে তাও যেকোনো সময় শেষ হয়ে যাবে।

সাউথখালী ইউনিয়নের ছয় নম্বর দক্ষিণ সাউথখালী ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. জাকির হোসেন হাওলাদার জানান, ওই রাতে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পরই এলাকাবাসী আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। আশপাশের প্রায় ৩০০ পরিবার আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। এরই মধ্যে নির্বাহী কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সবাইকে সাহস যোগান।

তিনি বলেন, রাতের মধ্যে যেকোনো উপায়ে বাঁধ মেরামত করা হবে। তার তাৎক্ষণিক উদ্যোগে সবাই রক্ষা পায়। তা না হলে জোয়ারের পানি ঢুকে বগী, সাউথখালী, গাবতলা ও চালিতাবুনিয়া গ্রামের শত শত পুকুর, মাছের ঘের, মাঠের বোরোধান ও ক্ষেতখামার নষ্ট হওয়াসহ ঘরবাড়ি তলিয়ে যেতো।

ওই ইউপি সদস্য জানান, শরণখোলার সবখানেই টেকসই বেড়িবাঁধের কাজ চলছে। অথচ ঝুঁকিপূর্ণ এবং ভাঙন কবলিত বগী-গাবতলায় কোনো কাজ হয়নি। এখানে নদী শাসন করে দ্রুত টেকসই বাঁধ নির্মাণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি।

সাউথখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোজাম্মেল হোসেন জানান, শরণখোলায় পাউবো’র ৩৫/১ পোল্ডারে সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মানাধিন বেড়িবাঁধ প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতায় সাউথখালীর সাত কিলোমিটার বাঁধ এখনো ঝুঁকিপূর্ণ। এ পর্যন্ত সাতবার বেড়িবাঁধ স্থানান্তর করা হয়েছে। সাউথখালীর বলেশ্বর পাড়ের মানুষের ঘর-বাড়িসহ কয়েক হাজার এক জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।

অন্যদিকে, বার বার বাঁধ নির্মাণ করতে গিয়ে জমি অধিগ্রহনের কারনে মানুষ ভূমিহীন হয়ে পড়ছে। ইতিমধ্যে শত শত পরিবার নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছে। একমাত্র নদী শাসন ছাড়া কোনোভাবেই এখানে বাঁধ রক্ষা করা যাবে না। ওই রাতে ইউএনও’র তাৎক্ষণিক উদ্যোগের প্রসংশা করেন তিনি।

শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সরদার মোস্তফা শাহিন বলেন, ওই রাতে ভাঙনের খবর পেয়ে মহাদুর্যোগ করোনাকে উপেক্ষা করে ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। তখন বাঁধের পাসের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখতে পেয়েছি। তারা আশ্রয়কেন্দ্র যাওয়ার প্রস্তুতি নিলে আমি তাদের বাঁধ মেরামতের আশ্বাস দিলে তারা সাহস পায়। এ সময় ডিসি স্যারের নির্দেশনা অনুযায়ী সিইআইপি মাঠ কর্মকর্তাদের খবর দিয়ে এস্কেভেটর মেশিন এনে রাত জেগে রিংবাঁধ নির্মাণ করি। রোজার সাহরী ওখানেই সারি। যে কোনো দুর্যোগ বা মানুষের বিপদে পাশের থাকা এবং তাদের সগযোগিতা করা আমার নৈতিক দায়িত্ব। সময়মতো বাধ নির্মাণ করতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত।

বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, শরণখোলার বেড়িবাঁধের ভাঙনের খবর শুনে দ্রুত ব্যবস্থার নেওয়ার জন্য ইউএনওকে নির্দেশ দেওয়া হয়। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ায় বড় ধরণের ক্ষতির হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করা সম্ভব হয়। ঝুঁকিপূর্ণ বগী ও দক্ষিণ সাউথখালী এলাকায় নদী শাসন করে শিগগইি কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ ছাড়া জেলার অন্য যেসব এলাকার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে তাও মেরামতের ব্যবস্থা করা হবে।

Leave A Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.