পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী বৈসাবি উৎসব

0

মুজিব উল্লাহ তুষার : পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী উৎসব হচ্ছে বৈসাবি। যাকে বাংলায় চৈত্র সংক্রান্তি হিসেবে ধরা হয়। পুরনো বর্ষকে বিদায় এবং নববর্ষকে স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়ে ঐতিহ্যবাহী এই বৈসাবি উৎসব পাহাড়ি জাতিসত্ত্বাসমূহের পারস্পরিক সম্প্রতি ও ঐক্যের প্রতীক। বৈসাবি পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের হাজার বছরের ঐতিহ্য। এটি পাহাড়িদের সবচেয়ে বড় পার্বণকাল। চৈত্রের শেষ দিন ও তার আগের দিন এবং নববর্ষের দিন নিয়ে মোট তিনদিন পর্যন্ত পাহাড়িদের ঘরে ঘরে এ উৎসব চলে। প্রতিবছর বৈসাবি আসে পাহাড়িদের মাঝে আনন্দের বার্তা আর নবজীবনের সোনালি স্বপ্ন নিয়ে। বৈসাবিকে কেন্দ্র করে ফুটে ওঠে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যম-িত সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। তাই এটি পাহাড়িদের সাংস্কৃতিক চেতনার উৎসস্থল সামাজিক সাম্যবাদের প্রতিফলন ।

বৈসাবি উৎসবের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের লোকজন বছরের শেষদিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিন পারস্পরিক সান্নিধ্য লাভ করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন ভাষায় এ উৎসবের ধরন ভিন্ন ভিন্ন হলেও উৎসবের লক্ষ্য ও রীতি প্রায় এক। বৈসাবিতে পার্বত্য অঞ্চলের তেরোটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা সকল ভেদাভেদ ভুলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শান্তির পৃথিবী গড়ে তোলার শপথ নেয়। চাকমা সম্প্রদায় এ উৎসবকে বলে ‘বিজু’ ত্রিপুরারা বলে ‘বৈসু’ আর মারমারা বলে সাংগ্রাই। ত্রিপুরাদের বৈসু, মারমাদের সাংগ্রাই ও চাকমাদের বিজু মিলে সংক্ষেপে এই উৎসবটির নামকরণ করা হয়েছে বৈসাবি। প্রতি বছর বিজু, সাংগ্রাই কিংবা বৈসুক শিশু থেকে বৃদ্ধ প্রতিটি পাহাড়িকে নাড়া দেয়। পার্বত্য শান্তিচুক্তির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িরা এখন সকল দ্বিধা, সংশয় ও উৎকণ্ঠা ঝেড়ে ফেলে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় উৎসবটি পালন করে। বৈসাবি’র আনন্দে পাহাড়ি মানুষ মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। প্রত্যন্ত পাহাড়ি পল্লী থেকে শুরু করে গ্রাম কিংবা শহরের ঘরে ঘরে বৈসাবি’র আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। উৎসবকে ঘিরে শহরের বিভিন্ন স্থানে এবং গ্রামাঞ্চলে আয়োজন করা হয়েছে ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা, নাচ, গান ও লটারি প্রতিযোগিতার। সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে বর্ষবরণ উৎসব পার্বত্য অঞ্চলে উদযাপিত হলেও বৈসাবি’র মাঝে এক আলাদা আবেদন রয়েছে। এর মাধ্যমে একের সঙ্গে অন্যের প্রতিশ্রুতি ও পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের ভীতকে সুদৃঢ় করে।

ধর্মীয় কিছু প্রভাব ভিন্ন ভিন্নভাবে এসব পালাপার্বণে লক্ষ করা গেলেও এটা একটা সামাজিক উৎসব হিসেবেই অধিকতর সমাদৃত। আদিকাল থেকে পাহাড়িরা স্বীয় বৈশিষ্ট্যের বিজু সাংগ্রাই ও বৈসু পালন করে আসছে। চাকমাদের মতে বিজুতে সবার মনে বয়ে আনে অপরুপ সম্প্রীতি। জাতি, শ্রেণি, ধনী, গরীব শত্রু-মিত্রের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ থাকে না। সবাই যেন এই সামাজিক উৎসবকে নিয়ে ব্যস্ত।
বিজু বয়ে আনে সম্প্রীতি, নতুন চিন্তা-চেতনা। চাকমা সমাজে এটি একটি অত্যন্ত আনন্দঘন দিন। এই দিনে আবাল বৃদ্ধ বনিতা সবাই পুরনো বছরকে বিদায় জানায় এবং নতুন বছরকে বরণ করে নেয়। এ দিনকে বলা হয় ‘দোর খেলা’ দিন। শুধু এই দিনটি নয় এই দিনের আগে ও পরের দু’টি দিনও পবিত্র এই সামাজিক উৎসবের সঙ্গে যুক্ত ‘বিজুর’ আগে দিনকে বলে ‘ফুল বিজু’। বিজুর দিনটিকে ‘মূল বিজু’ এবং পরের দিনকে বলে ‘গয্যা পয্যা দিন’ অর্থ্যাৎ পয়লা বৈশাখ।

ফুল বিজু : চৈত্র মাস শেষের দিন এটি পালন করা হয়। এই দিনটি বর্ষাবিদায়ী দিন বললেই চলে। এ দিন সকালে পাহাড়িরা বৌদ্ধবিহার, নদী বা খালে গিয়ে আগামী দিনের সুখ-সমৃদ্ধির জন্য ভগবান বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা করে। বিকেলে মোমবাতি এবং সাদা সুতা দিয়ে তৈরি বাতি সরিষার তৈল দিয়ে জ্বালিয়ে একই স্থানে প্রার্থনা করা হয়। ফুল দিয়ে ঘরে প্রতিটি দরজার মাঝখানে মালা গেঁথে সাজানো হয়। গরু-মহিষকে ফুলের মালা পরিয়ে দেয়া হয়। গোয়াল ও সম্পত্তি রাখার ঘরে যাতে কোনো ক্ষতি না হয় তার জন্য বাতি জ্বালিয়ে বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা করা হয়।
এদিনে ছোট শিশুরা খুব ভোরে হৈ চৈ করে ফুল তুলতে যায়। গৃহিনীরাও সারাদিন ব্যস্ত থাকেন ফল-মূল, খাদ্যদ্রব্য যোগাড় এবং আসবাবপত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজে। মোটামুটিভাবে ‘ফুল বিজু’ হচ্ছে ‘মূল বিজু’ উৎসবের প্রস্তুতির দিন। এছাড়া জাতীয় দেশি-বিদেশি খেলা ও নাচ গান এ দিনে হয়ে থাকে। উপজাতীয় খেলার মধ্যে গুডু হারা (হাডুডু খেলা), নাডেং হারা (লাটিম খেলা), গিলাহার (এক প্রকার বনজ ছোট চাকা দিয়ে খেলা), দড়ি টানটানি হারা, এই খেলা বিবাহিত- অবিবাহিতদের মধ্যে শক্তির পরীক্ষা। দড়ি টানার মাধ্যমে জয়-পরাজয় নির্ধারণ করা হয়। পরি হারা (চরকা খেলা), কান বুড়ি হারা (কানামাছি খেলা)সহ আরও কয়েকটি খেলা। দেশি-বিদেশি খেলার মধ্যে রয়েছে ফুটবল, ভলিবল, চেয়ার খেলা, দৌড়, হাইজাম্প, লং জাম্প, দাবা লুডু, ব্রিজ খেলাও। তবে এ খেলাধুলার আয়োজন করে থাকে মূলত ছাত্র, যুব ও সমাজসেবী সংগঠকরা।

মূল বিজু : ৩০ চৈত্র এই উৎসবটি পালিত হয়। এই দিনটি মূলত চৈত্রসংক্রান্তির দিন পার্বত্য অঞ্চলের চাকমা সম্প্রদায় এ দিনকে মূল বিজু বলে থাকে।
এ দিনে পাহাড়িদের ঘরে ঘরে বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করা হয়। যে খাবারটি প্রায় ঘরে ঘরে তৈরি করা হয় তা হলো অতি পরিচিত ‘পাচন’। এটি বিশটির অধিক তরকারি দিয়ে রান্না করা হয়। এই দিনে ঘরে তৈরি মদও অতিথিদের পরিবেশন করা হয়ে থাকে। এদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ঘর-বাড়ি পরিষ্কার করে ও স্নান সেরে নেয় সবাই। তারপর নতুন বা পরিষ্কার জামা-কাপড় পরে সবাই ঘুরতে বের হয়। অনেক রাত পর্যন্ত চলে এই ঘোরাফেরা।
এ সময় গান বাজনাও চলে। গয্যা পয্যা দিন : এ দিনটি হলো মূল বিজুর পরের দিন। অর্থাৎ ১ বৈশাখে এটি পালিত হয়। এই দিনে ভালো ভালো খাবার তৈরি করে বয়োজ্যেষ্ঠদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হয়। যাতে গুরুজনদের আশীর্বাদ পেয়ে আজীবন সুখী, সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী জীবনযাপন করা যায়। মারমা সম্প্রাদায়ও বৈসাবি উৎসবকে তিন ভাগে পালন করে। যেমন প্যেইং ছায়াই, আক্যা বা আক্যাই এবং আতাদা বা আপ্যাইং।

প্যেইং ছায়াই : মারমা সম্প্রদায় চাকমাদের মতো ফুল বিজুর মতোই দিনটি পালন করে। চাকমা সম্প্রদায়ের মতো মারমারাও এ দিনে গৃহপালিত পশু-গরু মহিষের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেয়। দুপুরে গ্রামের পুরুষ-মহিলা সবাই মিলে চলে যায়। বনে নানান ধরনের তরিতরকারি, ফলমূল সংগ্রহ করতে। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে সাংগ্রাইকে আনন্দবহ
করতে পরিচ্ছন্ন ও নতুন পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করে।

আক্যা : মূল সাংগ্রাইকে মারমা সম্প্রদায় আক্যা বা আক্যাই বলে। এদিন সকালে তরুণ-তরুণীরা পরস্পরকে পানি ছিটিয় আনন্দ উপভোগ করে এবং গ্রামে ঘুরে বুড়োবুড়ি এবং ক্যাং অথ্যাৎ বৌদ্ধ মন্দিরের উপাসক-উপাসিকাগণকে গায়ে সাবান মেখে স্নান করিয়ে দেয়। পরে ছেলেরা ধান বা চাল নিয়ে প্রত্যেকের বাড়িতে গিয়ে মোরগ-মুরগিকে তা ছিটিয়ে দেয়।
এর পিছনে কারণ হলো- মারমারা মনে করে তাতে গৃহলক্ষী সন্তুষ্ট হয়ে গৃহীকে আরও ধনদৌলত দেবেন। তারপর ছোওয়াইং নিয়ে ক্যাং-এ বুদ্ধ এবং ভিক্ষু সংঘকে আহার করায়্ বিকেলে ছোট-বড় সবাই মিলে বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষু কর্তৃক পঞ্চশীল গ্রহণ করে এবং সন্ধ্যায় ভগবান বুদ্ধের উদ্দেশ্যে প্রদীপ পূজা করে। আপ্যাইং বা

আতাদা : এ দিন মারমাদের ঘরে ঘরে সাধ্যমতো বিভিন্ন ধরনের পিঠা, বিরানি, পোলাও আর অতি পরিচিত পাচন রান্না করা হয়। এ দিনে হিংসা-বিদ্বেষ, ক্লেশ, ধনী, গরীব-জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মিলে দলে দলে একে অপরের বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। এ দিনে খাওয়ার চেয়ে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দটাই বেশি হয়ে থাকে। চাকমা, মারমা সম্প্রদায়ের মতো ত্রিপুরারাও বৈসু উৎসব (বৈসাবি) পালন করে তিনটি পর্যায়ে। হার বৈসু, বৈসুমা এবং বিসি কাতাল।

হারবৈসু : চৈত্রসংক্রান্তির আগে দিনকে বলা হয় হার বৈসু। চাকমাদের ফুল বিজুর মতোই এ দিনটি পালন করা হয় তবে। ত্রিপুরা সম্প্রদায় এ দিন থেকে কীর্তন এবং কয়েক দিন আগে থেকে “গারয়া নাচ” শুরু করে। গরযা নাচ ত্রিপুরাদের একটি ঐতিহ্যবাহী নৃত্য। এই নাচের দলে দুই বা তিনজন দলপতি এবং পঁচিশ জন যুবক কিশোর বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাচ দেখায়।

বৈসুমা : চৈত্রসংক্রান্তির দিনকে বলা হয় বৈসুমা। এদিন সকালে ত্রিপুরারা ঘুম থেকে উঠেই “কুচাই পানির” ফোঁটা ফোঁটা জলে নিজেদের সিক্ত করে। অর্থাৎ সোনা, রুপা ও তুলসী পাতা মিশ্রিত পানি ছিটিয়ে শুদ্ধ করে নেয়। মূল বিজুর মতোই এরা দিনটি পালন করে।

বিসি কাতাল : পয়লা বৈশাখকে বিসি কাতাল বলা হয়। এই গুরুজনদের পায়ে ফুল দিয়ে প্রণাম করে গোসল করানো হয় এবং তাদের আমন্ত্রণ করে খাওয়া হয়। এ দিনেও ত্রিপুরারা বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায়। এদিকে পাহাড়ে এখন বৈসাবি উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। আনন্দ উৎসবে দুলে উঠছে পার্বত্য এলাকার প্রতিটি জনপদ। আর কয়েক দিন পরেই অনুষ্ঠিত হবে বৈসু, সাংগ্রাই ও বিজু উৎসব। এ উপলক্ষে পার্বত্য ৩ জেলায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মাঝে নতুন করে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় হয়েছে।

(সাংবাদিক, সংগঠক ও মানবাধিকার কর্মী)

Leave A Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.