বেনাপোলে অব্যাহতভাবে রাজস্ব কমছে

0

মোঃ আয়ুব হোসেন পক্ষী, বেনাপোল প্রতিনিধিঃ
দেশের সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর বেনাপোল। ক্রমেই কমছে রাজস্ব আহরণ। সব মিলিয়ে এ বন্দর থেকে বছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়ে থাকে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় এক হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বন্দর-কাস্টমসের বিভিন্ন অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে এমনটা হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। এই ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার কোনো আশার বাণী শোনাতে পারেননি কাস্টমস কর্মকর্তারা।

বেনাপোল কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে বেনাপোল কাস্টমস হাউসে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ছয় হাজার ২৮ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) রাজস্ব আদায় হয়েছে এক হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা। রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে এক হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই বন্দরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল পাঁচ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছিল চার হাজার ৪০ কোটি টাকা। ঘাটতি ছিল এক হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। অর্থাত্ বিগত অর্থবছরে ১২ মাসে যে পরিমাণ রাজস্ব ঘাটতি ছিল, চলতি অর্থবছরে ছয় মাসেই প্রায় একই পরিমাণ রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে।

কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, জুলাইয়ে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৫৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা, আদায় হয় ২৫৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা। আগস্টে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫০৬ কোটি
২৯ লাখ টাকা, আদায় হয় ২০২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪০৫ কোটি ১০ লাখ টাকা, আদায় হয় ২৯৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। অক্টোবরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪২৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা, আদায় হয় ২৪৫ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। নভেম্বরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৩৩ কোটি ৯২ লাখ টাকা, আদায় হয়েছে ২৫৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা এবং ডিসেম্বরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৮৫ কোটি ৯ লাখ টাকা, আদায় হয় ২৯৪ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি করা হয়। সেই হিসাবেই স্থলবন্দরে পাঁচ হাজার কোটি টাকার অধিক রাজস্ব আদায় হওয়ার কথা। পণ্য আমদানির বেলায় এ স্থলবন্দরে চলে নানা অনিয়ম। কখনো পণ্য আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণা, আবার ঘোষণার অতিরিক্ত পণ্য এনে সরকারের শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হয়। এতে শুল্ক আয় কমে যাচ্ছে। তবে বৈধভাবে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করায় রাজস্ব ঘাটতির কারণ বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।

বন্দর সূত্রে জানা যায়, দেশের চলমান ১৩টি বন্দরের প্রধান হচ্ছে বেনাপোল স্থলবন্দর। প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে পণ্য আমদানির জন্য দেশে যতগুলো বন্দর রয়েছে, তার মধ্যে দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর হলো বেনাপোল। এ ছাড়া যোগাযোগব্যবস্থা দেশের অন্য যেকোনো বন্দরের তুলনায় উন্নত। বেনাপোল থেকে কলকাতার দূরত্ব মাত্র ৮৪ কিলোমিটার। সে কারণে দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ পণ্য এ বন্দর দিয়ে ভারত থেকে আমদানি হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।এ ছাড়া বৈধ আমদানি চালান কাস্টমস কর্তৃক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ছাড়া আবার বিজিবি সদস্যরাও আটক করছে। সেখানে দু-তিন দিন পণ্য চালান আটকে থাকছে। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিজিবি আর কাস্টমসের মধ্যে পরস্পরের সমন্বয় দরকার। এসব অনিয়মের কারণে দিন দিন এ বন্দরে রাজস্ব আদায়ে ধস নামছে।

আজমিরী ইন্টারন্যাশনালের মালিক সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী ও আমদানিকারক আবু তাহের ভারত বলেন, ভারতের ১৮ শতাংশ জিএসটি দিয়ে আনা পণ্যের মূল্য মানতে চান না বেনাপোল কাস্টমস। অহেতুক বাড়াবাড়িতে আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের নাভিঃশ্বাস উঠেছে। লোডেড ভ্যালু, ডাটা ভ্যালুসহ কাস্টমস কর্তৃপক্ষের মনগড়া সব ভ্যালুর চাপে আমদানিকারকরা বেনাপোল বন্দর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এ ছাড়া আমদানি করা পণ্যে চট্টগ্রামসহ অন্য বন্দরের চেয়ে ভ্যালু বেশি হলে সেটা কখনো কখনো কাস্টমস কর্তৃপক্ষ মেনে নেন। কিন্তু কম হলে মানেন না।উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে যে পণ্যের ভ্যালু ৩৫ সেন্ট, বেনাপোলে কাস্টমস তার ভ্যালু ধার্য করছেন এক ডলার। এসব অসামাঞ্জস্যতার কারণেই বেনাপোলে রাজস্ব আদায়ে ধস নেমেছে।

বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, সব বন্দরে আমদানি পণ্যের শুল্কায়ন মূল্য এক হতে হবে। সমজাতীয় পণ্যের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দরে যে মূল্যে শুল্কায়ন করা হয় বেনাপোল বন্দরে ওই পণ্যের ওপর লোড চাপিয়েশুল্ক আদায় করছে। তিনি বলেন, জায়গার অভাবে পণ্য খালাস করতে না পেরে ভারতীয় ট্রাক বন্দরে দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকছে। খোলা আকাশের নিচে রোদ-বৃষ্টিতে মূল্যবান পণ্যসামগ্রী পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বৈধ সুবিধা পেলে এ বন্দর থেকে বর্তমানে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব পাচ্ছে, তা বেড়ে দ্বিগুণ হবে।

বেনাপোল কাস্টমস হাউসের যুগ্ম কমিশনার শহীদুল ইসলাম জানান, মোট আমদানি কম হয়েছে বলে রাজস্ব আদায় কম হয়েছে। যেমন—চেসিস গত বছর যা এসেছিল, এবার তার ৪০ শতাংশও আসেনি। ৬০ শতাংশ চেসিস কম এসেছে। আমাদের রাজস্ব চেসিস থেকে বেশি আসে। আমদানি না হলে রাজস্ব কোথা থেকে আসবে। পণ্য চালান খালাসে আগের চেয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বেড়েছে। শুল্ক ফাঁকি বন্ধে কড়াকড়ি আরোপ করায় কিছু ব্যবসায়ী এ বন্দর দিয়ে আমদানি কমিয়েছেন। বিশেষ করে রাজস্ব বেশি আসে এমন পণ্য কম আমদানি হচ্ছে। এতে রাজস্ব কিছুটা ঘাটতি হয়েছে।

বেনাপোল বন্দরের উপপরিচালক (ট্রাফিক) মামুন কবির তরফদার জানান, তিনি বন্দরে দায়িত্ব নেওয়ার আগে কিছুটা অব্যবস্থাপনা ছিল। যোগদানের পর বন্দরে অবৈধ প্রবেশ নিষেধ ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছেন। বাণিজ্যে গতি ফেরাতে ইতিমধ্যে স্বল্প পরিসরে অটোমেশন প্রক্রিয়ায় কাজ শুরু হয়েছে।

Leave A Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.