চিকিৎসা সেবায় মানুষের আস্থা সংকট: সমাধান জরুরী

0

গত কয়েক দশক ধরেই চট্টগ্রামসহ সারাদেশে চিকিৎসা সেবায় অনিয়ম, ডাক্তাররা যথাযথ সময় দিচ্ছেনা, রোগী দেখার সাথে সাথেই অসংখ্য পরীক্ষার বোঝা চাপিয়ে দেয়া, এম, আরদের থেকে ডাক্তাররা বিভিন্ন কোম্পানীর সুযোগ সুবিধা গ্রহনের জন্য অতিরিক্ত সময় দেয়া, নগরীতে অনুমোদনহীন অসংখ্য অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়গনষ্টিক সেন্টার গড়ে উঠা, ডাক্তাররা রোগীদের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন, পরীক্ষা নিরীক্ষায় ভুল ফলাফলের কারনে রোগীদের মাঝে জমছে ক্ষোভ ও আস্থাহীনতা। এতে জনগণের মাঝে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় নেতিবাচক মনোভাবের পাশাপাশি রাজস্বও হারাচ্ছে সরকার। অনেকেই আস্থাহীনতার কারনে চিকিৎসাসেবা নিতে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন। যা একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জন্য হুমকি স্বরুপ।
০৩/০৭/২০১৮ইং তারিখে দৈনিক পূর্বকোনে প্রকাশিত একটি সংবাদে দেয়া তথ্যসুত্র মতে যুক্তরাজ্যের ১৭০ বছরের পুরনো মেডিকেল জার্নাল বিআমজে গত বছর শেষে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে একজন ডাক্তার গড়ে ৪৮ সেকেন্ড রোগীর জন্য সময় দেয়। যেখানে উন্নত বিশ্বে সুইডেন, নরওয়ে, আমেরিকার ডাক্তাররা রোগীদের জন্য গড়ে প্রায় ২০ মিনিট করে সময় দিচ্ছেন। এরমধ্যে সুইডেনের ডাক্তাররা ২২.৫ মিনিট করে গড়ে একজন রোগীর পিছনে সময় দেন। এছাড়া ভারতের ডাক্তাররাও খুব বেশী হলে ২ মিনিট সময় দেন আর পাকিস্তানের ডাক্তাররা ব্যয় করেন১.৩ মিনিট। ৬৭ টি দেশের ২ কোটি ৮৫ লাখ ৭০ হাজার ডাক্তারী সেবার পরিচালিত জরিপে এ চিত্র উঠে আসে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয় , বাংলাদেশ, পাকিস্থান ও চীনে স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে কোন অ্যাপয়েন্টমেন্ট পদ্ধতি চালূ নেই। ফলে ডাক্তাররা প্রতিদিন ৯০ জন বা তারও অধিক রোগী দেখে থাকেন। শুধু তাই নয় পুনরায় সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রেও তারা যথেষ্ট পরিমান ফি আদায় করেন।
তাছাড়া জানা যায়, প্রতিটি ডাক্তারদের সাথে প্রতিটি ডায়গনষ্টিক সেন্টারের সাথে কন্ট্রাক্ট থাকে, প্রতিটি রোগীর প্যাথলজী বা বায়ো পরীক্ষা নিরীক্ষায় ৫০% পর্যন্ত ডাক্তাররা কমিশন পেয়ে থাকেন। যা একটি রোগীর জন্য মরার উপর খাড়ার ঘা। আর এই ট্রেডিশনালটা বাংলাদেশে শক্ত প্রচলিত হয়ে গেছে। এর থেকে বেরিয়ে আসা খুবই দুষ্কর। অভিযোগ পাওয়া যায়, পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে করতে অনেক রোগী সর্বস্বান্ত হয়ে যান। যার ফলে পরে কোন বড় রোগ হলেও পরীক্ষা নিরীক্ষার ভয়ে ডাক্তারদের ধারে কাছেও ঘেষেননা।
জানা গেছে, এগুলোর পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন বেসরকারী মেডিকেল ও ক্লিনিকগুলোতে অনিয়ম ও অবহেলার অভিযোগ। আয়া থেকে শুরু করে সবাই বিভিন্ন কায়দায় টাকা নিতে ব্যস্ত। সবকিছু মিলিয়ে ডাক্তারদের প্রতি ও তাদের চিকিৎসাসেবার প্রতি রোগীদের একটা আস্থার সংকট তৈরী হচ্ছে। গত ২৯শে জুন চট্টগ্রামের বেসরকারি ম্যাক্স হাসপাতালে সাংবাদিক রুবেল খানের একমাত্র কন্যা রাইফা খানের ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনায় সাংবাদিকমহলসহ পুরো শহর জুরে আতংক সৃষ্টি হয়েছে। মানববন্ধন ও প্রতিবাদের ঝড় বইছে এই হত্যায় দায়ী ডাক্তারের বিরুদ্ধে। সাংবাদিক ও ডাক্তারদের দুই পেশাজীবি গ্রুপ মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। কয়েকজন ডাক্তারের দাম্ভিকতা দেখে চমকে যেতে হয়। সেইসাথে উঠে আসছে অনেক অজানা তথ্য ও ম্যাক্স হাসপাতালের বৈধতা নিয়ে।
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী চট্টগ্রাম শহর ও উপজেলা পর্যায়ে ৫০৪টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে। তবে অভিযোগ আছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়াই অসংখ্য ক্লিনিক হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। আবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন থাকলেও নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। চট্টগ্রামে ৭৩ হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়গনষ্টিক সেন্টারের পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। এর মধ্যে চট্টগ্রাম শহরে আছে ১৯টি। তবে কি পরিমান হাসপাতাল ক্লিনিক, ডায়গনষ্টিক সেন্টার অনুমোদন ছাড়া অবৈধভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে তার সঠিক তথ্য নেই সিভিল সার্জন দপ্তরে। এই অনুমোদনহীন অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়গনষ্টিক সেন্টার খুব শীঘ্রই বন্ধ করে দেয়া দরকার। ভুল চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে নাগরিকদের পরিত্রান পাওয়া তার অধিকার। চিকিৎসা সেবার মতো জনগুরুত্বপূর্ন একটি বিষয় এভাবে অবহেলায় চললে জাতির জন্য চরম দুর্ভোগের কারন হয়ে উঠবে। এতে সরকারও দায় এড়াতে পারবেনা। তাই অতি শীঘ্রই সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ আশু সমাধানে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া অতীব জরুরী। উপরোক্ত সমস্যাগুলো সমাধান করলেই দেশের মানুষ দেশেই আস্থার সাথে চিকিৎসাসেবা গ্রহন করতে আগ্রহী হয়ে উঠবে। সরকারও এই সেক্টর থেকে রাজস্ব আদায় করতে পারবে।

লেখকঃ কাজী হুমায়ুন কবির

Leave A Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.