রমজান মাসে প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক নর-নারীর জন্য রোজা রাখা ফরজ। কিন্তু ডায়াবেটিস রোগীরা এই ফরজ কাজটি করতে গিয়ে বেশ অসুবিধায় পড়ে যান। কারন এই সময় খাদ্যাভ্যাস ও ওষুধের সময়সুচির পরিবর্তনে তাদের শরীরে ক্যালরি এবং ওষুধের মধ্যে সামঞ্জস্যহীনতা দেখা দেয়। যার কারনে রক্তে শর্করার মাত্রা হঠাৎ বেড়ে আবার কমে যেতে পারে। তাই রমজান মাসে রোজা রাখার জন্য, ডায়বেটিস রোগীদের পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহন করা প্রয়োজন।
বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, রমজান মাসে ডায়বেটিস রোগীদের শরীরে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার মাত্রা বেড়ে যায়। আর এর মূল কারন হল, দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার কারনে শরীরের পানিশূন্যতা। এসময় গরম ও আর্দ্র আবহাওয়া এবং কঠোর পরিশ্রমের ফলে হাইপোগ্লাইসেমিয়ায় অতিরিক্ত প্রসাবের কারণে শরীরে পানি শূন্যতা দেখা দিতে পারে। সেই সাথে শরীরে ইলেকট্রোলাইটের পরিমাণও কমে যেতে পারে। ফলে ব্লাড পেশার কমে গিয়ে অজ্ঞান হওয়া, পড়ে গিয়ে আঘাত পাওয়া, হাড় ভেঙ্গে যাওয়াসহ বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে।
করনীয়ঃ পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে প্রথমেই ডায়বেটিস রোগীদের জেনে রাখা ভালো যে, তাদের শরীর রোজা রাখার জন্য উপযুক্ত কি না। শরীরে শর্করার মাত্রা খুব বেশী অনিয়ন্ত্রিত থাকলে, তাদের রোজা রাখা উচিত নয়। অর্থাৎ যদি, তিন মাসের মধ্যে মারাত্মক হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা শর্করাস্বল্পতা, কিটোঅ্যাসিডোসিস বা শর্করার মারাত্মক আধিক্য থাকে তাহলে রোজা না রাখাই ভালো। এছাড়াও রোগীর যদি ডায়বেটিস ছাড়াও অন্যান্য শারীরিক সমস্যা যেমন যকৃতের সমস্যা, হৃদরোগ ও কিডনি সমস্যা থেকে থাকে, তাহলে তাদের রোজা না রাখাই ভালো। অন্যদিকে যারা কেবল খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়ামের মাধ্যমেই শর্করা নিয়ন্ত্রণ করছেন বা মেটফরমিন, ডিপিপি ৪ ইনহিবিটর বা গ্লিটাজন শ্রেণীর ওষুধ খান তাদের রোজা রাখা বেশ নিরাপদ। যারা ইনসুলিন বা ওষুধ ব্যবহার করেন তাদের ক্ষেত্রে কিছুটা ঝুঁকি রয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের অবশ্যই নতুন করে ওষুধের মাত্রা ও সময় জেনে নিতে হবে।
খাদ্যাভ্যাসঃ
ইফতারিঃ রমজান মাসে এসব রোগীদের ক্যালোরির চাহিদা আগের মতন থাকলেও, যেহেতু খাদ্য গ্রহন আর সময়ের বেশ কিছুটা পরিবর্তন আসবে তাই ইফতারে বিকল্প চিনি দিয়ে ইসবগুলের ভুষি, তোকমা, লেবু কাঁচা আম বা তেঁতুল শরবত এসব রোগীদের জন্য উপকারী। আর ডাব ছাড়া অন্যান্য মিষ্টি জাতীয় ফলের রস না খাওয়াই ভালো। টক আর মিষ্টি উভয় ধরনের ফলের মিশনে তৈরি সালাদ তাদের জন্য ভালো। এতে করে খনিজ লবণ ও ভিটামিনের অভাব পূরণ হবে। কাঁচা ছোলার সঙ্গে আদাকুচি, টমেটো কুচি, পুদিনা পাতা ও লবণের মিশ্রণ বেশ সুস্বাদু খাবার। কাঁচা ছোলা রক্তের কোলেস্টেরল কমাতে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। ইফতারে একসঙ্গে বেশি না খেয়ে অনেক খাবার ধাপে ধাপে ভাগ করে খান। এতে রক্তে হঠাৎই শর্করার মাত্রা বেড়ে যাবে না।
রাতের খাবারঃ ডায়বেটিস রোগীদের রাতের খাবার একেবারে বাদ দেয়া উচিত নয়। অল্প করে হলেও খেতে হবে। চিকিৎসকের বরাদ্দ খাবারের পরিমানের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে, রোগী রাতের বেলায় ভাত খেতে পারবেন। এসময় হালকা মসলায় রান্না যে কোনো ছোট-বড় মাছ এবং সবজি নিয়মিত খাওয়া যেতে পারে।
সেহেরিঃ ভোররাতে রুচি অনুযায়ী রুটি অথবা ভাত খেতে পারেন। সেহেরির খাবারের পরিমান হতে হবে, অন্যদিনের দুপুরের খাবারের সমপরিমান। সেহরিতে মাছ ও সবজি আর সাথে ডাল থাকতে পারে। সবশেষে দুধ রাখাও ভালো।
ইনসুলিনঃ রমজান মাসে খাবার সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে ওষুধ আর ইনসুলিনের মাত্রা ও সময়সুচিও পরিবর্তিত হয়। এসময় ডায়বেটিস বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহন করে, ওষুধের সময় পরিবর্তন করে রাতে নিয়ে আসতে হবে। ওষুধের মাত্রা রক্তে শর্করার পরিমাণের ওপর অনেকটাই নির্ভর করে। এ কারণে নিজ থেকেই ওষুধের সময়সূচি পরিবর্তন করা যাবে না। অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ব্যায়ামঃ ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে যারা প্রতিদিন রুটিনমাফিক ব্যায়াম ও হাঁটাহাঁটি করেন, রমজান মাসে তাদের সে রুটিনেও পরিবর্তন আনতে হবে। রোজা রেখে ব্যায়াম ও খুব বেশি হাঁটাহাঁটি করা ঠিক হবে না। তবে ইফতারের একঘণ্টা পর ও সেহরির আগে ব্যায়াম করে নিতে পারেন।
সর্তকতাঃ
* ডায়াবেটিসের সঙ্গে অন্য কোনো জটিলতা, যেমন- কিডনির রোগ, উচ্চমাত্রার ইউরিক থাকলে ডালের তৈরি খাবার থেকে বিরত থাকতে হবে।
* আলসার বা গ্যাসট্রাইটিসের সমস্যা থাকলে ডুবো তেলে ভাজা ও ঝাল যুক্ত খাবার পরিহার করুন।
* শরীরের ওজন বেশি থাকলে যতটা সম্ভব কম খাবার গ্রহণ করুন এবং খাবারে তেলের পরিমাণ কমিয়ে দিন।
* রোজা রেখে অত্যধিক হাঁটা বা ভারী ব্যায়াম থেকে বিরত থাকুন। কারণ এতে আপনার শরীরে রক্তের শর্করার মাত্রা নিচে নেমে গিয়ে বিপদ হতে পারে।
রমজানে ডায়াবেটিস রোগীদের শরীরের প্রতি বিশেষ যত্নবান হওয়া উচিত। কারণ শরীর সুস্থ না থাকলে রোজা রাখা এসব রোগীর জন্য অনেক সময় নিরাপদ নাও হতে পারে। তাই শরীর সুস্থ রাখতে দৈনন্দিন খাবারের ব্যাপারে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে ডায়াবেটিস রোগীদের।
সংগৃহীত